দুর্ভাগ্যের দুর্ভোগ

দুর্ভাগ্যের দুর্ভোগ

-রীণা চ্যাটার্জী

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু দিনে পালিত হয় “ভ্যালেন্টাইন ডে”- ভালোবাসা দিবস। রাজার নির্দেশ অমান্য করে নীরব বিদ্রোহে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি- ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে মিলন উন্মুখ যুগলের ধর্মীয় বন্ধনে পৌরহিত্য করতেন। তাই তৎকালীন যুদ্ধপ্রেমিক রোমান সম্রাটের রোষানলে পড়ে মৃত্যু দণ্ডাদেশে প্রাণ হারান তিনি এই দিনে। আমরা পালন করি সাড়ম্বরে ভালোবাসা দিবস! আর ঠিক সেই বিশেষ দিনটিতে ভারতবর্ষ রক্তাক্ত হলো, বীর সন্তানের রক্তে পিচ্ছিল হলো আমাদের জন্মভূমি। অতর্কিত সন্ত্রাসবাদী হানায় স্তব্ধ দেশ। বিদেশ থেকেও ভেসে এলো ধিক্কার ধ্বনি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অমানবিক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়ার অভিযোগে তোলপাড় হলো দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল। মুখর হলো সামাজিক মাধ্যম। বিশিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের বিশেষ বিশেষ মতবিনিময়- মতবিরোধ চললো পর্যায়ক্রমে। যথারীতি সরকার ও বিরোধী পক্ষের চাপান-উতোর চললো ‘ইঞ্চি’ মেপে দফায় দফায়। সংখ্যা, পরিসংখ্যান, তথ্য সব বিতর্কের কেন্দ্রে। অনুগামীরাও তরজায় নামলেন নানা শ্লোগান নিয়ে।

এরমধ্যে একটি বিশেষ প্রশ্ন উঠেছে ওঁদের ‘শহীদ’ কেন বলা হবে? যুক্তি- তাহলে কর্মরত অবস্থায় যে কারোর মৃত্যু হলে সেই শহীদ হবে। দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের যে এদেশের বিদগ্ধ জনেরাও এই প্রশ্নে সামিল হলেন। ‘শহীদে’র সংজ্ঞা কি ভুলে গেলেন মাননীয়রা! যাঁরা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারেন না, মৃত্যুবরণ করেন তাঁরাই ‘শহীদ’। আর সৈনিকরা যখন উর্দি পড়েন সেই মুহূর্ত থেকেই ওরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকেন। যুদ্ধ হোক বা না হোক। দেশমাতার সেবায় ব্রতী এই মানুষদের বেতনভুগী কর্মচারী বলার মতো অসংযত, অপ্রয়োজনীয়, অন্যায় মনে হয় না আর কিছু হতে পারে। আর সেনাবাহিনীর কর্মের সাথে অন্য কর্মের তুলনা করার ধৃষ্টতা নাই বা করলাম আমরা, সর্বসংহা এই মানুষদের জন্য থাকুক না মন ভরে শুধু সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১লা মার্চ আবার এক পরীক্ষার শুরু, প্রতীক্ষার শুরু। আর এক বীর সন্তান শত্রুর ঘেরাটোপে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো বুক। অতীতের নৃশংস ইতিহাস মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল কতোটা বীভৎসতার মধ্যে আছে? কতো নৃশংস হয়েছে ওই দুর্বৃত্তরা? কেমন আছে আমার সন্তান? হ্যাঁ, বড়ো দুঃসাহসিক স্পর্ধায় আর ভীষণ মমতায়, অনেক গর্বে বললাম ‘আমার সন্তান’– “অভিনন্দন” তখন সবার, আমাদের সবার সন্তান। তখনো চলছিল তর্কের কাজিয়া– ভালো লাগছিল না। আমার মতো ঘরে ঘরে মা সেদিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে। অসংখ্য বোন তার ভাইয়ের হাতে রাখীর বন্ধনের শর্তের কথা ভেবে বুক বেঁধেছে। সহস্র সন্তান তার বাবার নিরাপত্তায় উৎকন্ঠার প্রহর গুনেছে।

চলার পথে যুক্ত হয়েছি অনেক সৈনিক পরিবারের সাথে, খুব কাছ থেকে দেখেছি তাদের দিন-রাত, সুখ-দুঃখ। দেখেছি কর্মে যোগ দিতে যাবার আগে একধারে তাদের মানসিক দৃঢ়তা, কর্তব্যপরায়ণতা। অন্যধারে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অজানা উদ্বেগ পরিবারের সবার। যাত্রার ঠিক আগে মুখে থাকে হাসি, ভালো থাকার সতর্কবাণী, ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি আর চোখে থাকে উদ্বেগের প্রশ্ন। স্তব্ধ হয়ে যায় জীবন ওদের অনেক সময়, যখন খবর পায় না তাদের মা, বোন, প্রিয়া, সন্তান। চোখের জল ফেলে না কেউ অমঙ্গলের আশঙ্কায়- শুকনো খরস্রোতা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে বাতায়নে। বাতাসে ভেসে আসুক সুখবর এই আশায়। তাই নিতে পারে না মন অহেতুক এইসব তর্ক, স্বার্থের নোংরামি, রাজনৈতিক মুনাফা, ভোটের গণিত। দুর্ভাগা দেশ আমাদের, দিতে পারলো না বীর সন্তানদের যোগ্য প্রাপ্য সম্মান। হতভাগ্য আমরা তাই-বুঝলাম না কাদের জন্য আমরা সুরক্ষিত। কিছু কিছু কর্মের মূল্য বিনিময় বিচার করা ধৃষ্টতা, মানতে পারলাম না সবাই। একমত হতে পারলাম না দুর্ভাগ্য আমাদের।

আমাদের প্রিয় স্বজন সাথীরা তাঁদের কলমের কান্নার কথা,গর্জে ওঠার কাহিনী সব কিছুর সাক্ষী রাখতে ‘আলাপী মনে’ দিয়েছিলেন তাঁদের রচনা। কিছু কিছু লেখায় ছিল হিংসা মিশ্রিত প্রতিবাদ। সেক্ষেত্রে এই বিশেষ বিষয়ে লেখা প্রকাশিত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ক্ষমাপ্রার্থী। তাই বিশেষ কলমের প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া শ্রেয় মনে করি।

শুভকামনা, শুভেচ্ছা সবার জন্য আলাপী মনের পক্ষ থেকে।।

Loading

3 thoughts on “দুর্ভাগ্যের দুর্ভোগ

  1. অত্যন্ত সুচিন্তিত মতামত, খুব ই সুন্দর লেখা। এ লেখা বলতে গেলে আমাদের মতো অনেকের ই মনের কথা। অসংখ্য ধন্যবাদ সম্পাদিকা কে এতো পরিছন্ন ও সাবলীল ভাবে কঠোর সত্য কে তুলে ধরার জন্য….

Leave A Comment